2018-10-02

‘নাফের উপর কুয়াশার সাদা রেখার মতো স্বপ্ন ভাঙে আর গড়ে; বাড়তে বাড়তে মংডু পাহাড়ের মাথায় চলে যায়।’

বছর পাঁচেক আগে পরিচিত হয়েছিলাম মানিক বন্দোপাধ্যায়ের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ র পদ্মা পাড়ের জীবনের সাথে। তার কিছুদিন পরেই সামনে এলো ‘পোকা মাকড়ের ঘরবসতি’র নাম। তবে তখন এর লেখককে বা তার কাজের সাথে কোন পরিচয় না থাকলেও মগজে গেঁথে রইলো অদ্ভুত এই নাম।

তারপর বিভিন্ন মাধ্যমে হালকার উপর ঝাপসা তথ্য জানতে পারলাম, এই উপন্যাসের উপজীব্য ও সেই জলের সাথেই সম্পর্কিত- তাও আবার আমার জন্ম ও বেড়ে উঠার স্থান চট্টগ্রাম এবং চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা তার প্রাণ।

তখন থেকেই সময় ও সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম। অবশেষে ইহাকে আমি পাইলাম আর ‘শেষ হইয়াও হইলোনা শেষ’ করার মত তৃষ্ণা নিয়েই বইটি শেষ করলাম।



উপন্যাসটির উপর ভিত্তি করে নির্মিত বাংলা সিনেমার পোস্টার

চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা ছোটবেলা থেকেই দুর্বোধ্য ঠেকে আমার কাছে। তবে এর অপূর্ব টান আর গতিতে সব সময়ই অবাক হতাম। চিন্তা করতাম, এই ভাষা এত দ্রুত আর সংক্ষিপ্ত হলো কি করে?

এরপর কোন উৎস থেকে জানলাম, সাগর পাড়ের এই অধিবাসীরা অধিকাংশই ব্যবসায়ী হওয়ায় তারা সব সময়ই থাকে অতিরিক্ত ব্যস্ত আর চঞ্চল। এই জন্য তাদের ভাষাকেও সেই ব্যস্ততার গতিময়তার অংশ করে নিতেই ভাষাটিকেও তারা করে নিয়েছে সংক্ষিপ্ত আর দ্রুত লয়ের।



বলাই বাহুল্য, পদ্মা পাড়ের মানুষের সেই জীবন ধারায় এক সময়ে এসে এক ঝিমিয়ে পড়া ভাব লক্ষ্য করা গেলেও, ভাষা আর জীবনের এই গতির মতই নাফ নদীর পাড়ের এই উপন্যাসটির মানুষগুলার জীবনের পরিবর্তনগুলোও আশ্চর্য গতিতে দ্রতই চোখের পলকে পরিবর্তিত হয়ে যায়।

উপন্যাসের শুরুতেই চোখে পড়ে ‘দুহাতের মুঠোয় একগাদা ঝিনুক নিয়ে ভুস করে মাথা’ ওঠানো মালেক যে কিনা সাগরের টানে তার জীবন বাজি রাখতেও রাজি!

দক্ষিণাঞ্চলের মানুষদের নিয়েই লেখা এই উপন্যাস । নাফ নদীর তীরে ছোট্ট এক দ্বীপের বুকে এইসব মানুষের বসতি । মানুষের, না পোকামাকড়ের? দৃশ্যমান বাস্তবতা তো পোকামাকড়ের কথাই বলে। কিন্তু সেই ঘরবসতিতে আমরা তো মানুষকেই দেখতে চাই । সাহসী, লড়াকু, সপ্নতাড়িত, প্রেমময় মানুষ । পিষ্ট হতে হতে শেষে মাথা তুলে দাঁড়াবে, এমন মানুষ । জলদাস নয়, জলের অধিপতি হিসেবেই বেঁচে থাকবে মানুষ । তাদের কুশলী শ্রমে রুপোলী মাছ আটকে যাবে জালের সুতোয়, স্বপ্নের মধ্যে জালের গুটি টুং টাং বেজে উঠবে যেন অলৌকিক সঙ্গীত । সব জলদাস দাঁড়াবে এসে এক আলোকিত মিছিলে- পুরোভাগের সাহসী মানুষটির চোখে ভিড় করবে স্বপ্নঘেরা এক ভূখণ্ডের মানচিত্র । হাঙরদের পরাভূত করে উঠে আসবে জলমগ্ন মানুষের দল ।

নাফ নদীর পাড়ের অন্যান্য মানুষগুলোর তুলনায় ভিন্ন মানসিকতার অধিকারী আর মানবিকতার একনিষ্ঠ পূজারি হওয়ায় স্বভাবই মানুষটা হয়ে ওঠে নিঃসঙ্গচারী!

সারাজীবন ধরে তার ভালোবাসার মানুষটির মনোযোগ আকর্ষণ করতে ব্যর্থ হওয়ায় আর সংসার করাও কখনো হলো না তার! যেখানে জোর করে অমানবিক হওয়াটাই তার আকাঙ্খিত মানুষটার কাছে পৌরষের প্রতীক সেখানে অন্যের ইচ্ছার উপর জোর না খাটিয়ে মনুষ্যত্বকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টাই হয় মালেকের জীবনের ব্রত। আর অন্যদিকে, তার আকাংক্ষিত সেই স্বপ্নের মানুষ সাফিয়ার নিজের আত্মার খোরাক না মিটিয়ে শুধু বৈষয়িক হবার আকাংক্ষাই তাকে জীবন সংগ্রামে হারিয়ে দিতে থাকে চিরতরের জন্যই।

Tasnim Binta Saif

The post সেলিনা হোসেনের ‘পোকামাকড়ের ঘরবসতি’র পাঠানুভূতি appeared first on Bangladesh Study Forum.

Show more