সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী জ্ঞানতাপস আব্দুর রাজ্জাক ফাউন্ডেশন আয়োজিত সেমিনারে ইদানিং তাঁর বক্তৃতায় বাংলাদেশের জাতীয়তার উপর যে বক্তৃতা দিয়েছেন, তার সাথে একটু দ্বিমত পোষণ করে আমার এ আলোচনার সূত্রপাত করছি। আমার দ্বিমত পোষণ করা মানে এনয় যে আমি তাঁর সব কথার সাথে দ্বিমত প্রকাশ করছি।
প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাক আর প্রফেসর সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, দুজনই আমার অত্যন্ত শ্রদ্ধাভাজন, প্রাক্তন শিক্ষক ও সহকর্মী। যদিও তাঁরা কেউই প্রত্যক্ষ ভাবে আমার শিক্ষক ছিলেন না, পরোক্ষ ভাবে আমি দুজনের কাছেই ভীষণ ঋণী। দুজনই আমাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার পাশাপাশি গবেষণা করার কাজে অনেক সাহায্য ও সহযোগিতা করেছেন, প্রেরণা জুগিয়েছেন। প্রফেসর চৌধুরীর সম্পাদনায় Dhaka University Studies আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পত্রিকায় ডজন খানিক প্রবন্ধ প্রকাশ (১৯৭৪-১৯৮০) আমার জন্য গবেষণার ও জ্ঞানার্জনের দ্বার উম্মোচন করেছিল, এটা আমি কৃতজ্ঞতার সাথে সারা জীবন মনে রাখবো।
আমার “পূর্ব বাংলার কৃষক ও রাজনীতি (১৯২০-১৯৪৭)” বিষয়ে (পিএইচডি) গবেষণার কাজে রাজ্জাক স্যার আমাকে নানা ভাবে সাহায্য করেছেন, উৎসাহ দিয়েছেন । তাঁর বাড়িতে বসিয়ে, নিজ হাতে রান্না করে “বিলেতি ব্রেকফাস্ট” খাইয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সামাজিক ইতিহাস, ভারতীয়, পাকিস্তানী, আর বাংলাদেশী জাতীয়তার ক্রমবিকাশের নানান খুঁটি-নাটি নিয়ে আলোচনা করে আমার জ্ঞান বৃদ্ধি করেছেন, এটা আমি কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করি। পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদ যে একেবারে একটা উদ্ভট ব্যাপার ছিল না এটাও আমি তাঁর কাছে, নতুন ভাবে শিখেছি। জাতীয়তাবাদ যে কোন সহজ ফর্মুলা-নির্ভর একটা সহজ বিষয় নয়, এটাও রাজ্জাক স্যার আমাকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে, নানান উদাহরণ দিয়ে শিখিয়েছেন। বেনেডিক্ট অ্যান্ডার্সন তার কালজয়ী গ্রন্থ The Imagined Community রচনার বেশ আগেই রাজ্জাক স্যার এটা আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে জাতি বা জাতীয়তাবাদ একটা আবেগ বা অনুভূতির ব্যাপার। এটা কোন rational বা যৌক্তিক সিদ্ধান্ত-নির্ভর বিষয় নয়।
আমি মনে করি, জাতি বা জাতীয়তাবাদ কোন চিরস্থায়ী ব্যাপার নয়। কালের আবর্তনে যেমন ভারতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসক প্রবর্তিত Permanet Settlement (১৭৯৩) বা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চিরস্থায়ী হয় নি, তেমনি সব জাতি, জাতীয়তাবাদ, বা জাতি-রাষ্ট্র (nation-state) চিরস্থায়ী ভাবে যুগ-যুগ টিকে থাকবে না। এককালে যেটা মুঘল সাম্রাজ্য ছিল , পরে সেখানে হাজারের উপর রাজ্যের উদ্ভব হয় । ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক যুগেও ভারতবর্ষে ৫০০-এর উপর দেশীয়-রাজ্য ছিল। ১৯৪৭ সালেও অনেকের কাছে যা অভাবনীয় ছিল, সেটা ঘটে গেলো। “দেশ-ভাগ” হয়ে ভারত ও পাকিস্তানের সৃষ্টি হলো। আবার ১৯৭১ সালের ২৮এ ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত যেটা অভবনিয় ছিল, সেটা ঘটলো। পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী, যারা ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান গঠনে সবচাইতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিল তারা পাকিস্তানী রাষ্ট্র থেকে বের হয়ে বাংলাদেশ নামে এক নতুন রাষ্ট্র সৃষ্টি করলো , এবং এই রাষ্ট্র গঠিত হলো বাঙালি বা বাংলাদেশী জাতীয়তার উপর নির্ভর করে।
এক কথায়, জাতীয়তাবাদ (Nationalism) এবং জাতি (Nation) কোন প্রাকৃতিক বা বিজ্ঞানসিদ্ধ নিয়ম, সংজ্ঞা,বা তত্ত্ব দিয়ে বিশ্লেষণ করা যায় না । জার্মানির বা জাপানের ব্যাপারে যেটা মীমাংশিত সত্য, ভারত, পাকিস্তান, বা বাংলাদেশের ব্যাপারে সেটা নাও হতে পারে। ন্যাশনহুড, ন্যাশনালিজম, বা নেশন সব সময় ভূগোল, ভাষা, race , গোত্র, বা ধর্ম-নির্ভর নয়। উপরোক্ত সব গুলো উপাদান থাকলেও কোন জনগোষ্ঠী আপনাপনি একটা জাতি বা নাশনে রূপান্তরিত হয় না। উপরোক্ত যে কোন একটা থাকলেও যেমন এক জনগোষ্ঠী এক জাতি বলে পরিগণিত হতে পারে, আবার তেমনি উপরোক্ত বেশির ভাগ উপাদানের সহাবস্থান ছাড়াও একটা জনগোষ্ঠী নিজেদের একটা স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে ঘোষণা করতে পারে, এবং কালক্রমে সবাইর স্বীকৃতি লাভ করে একটা নেশন-স্টেট তৈরী করতে পারে। ইতিহাস জুড়ে এর শত-শত উদাহরণ রয়েছে।
আমি সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর একটা প্যারাগ্রাফ নিয়ে আমার দ্বিমত সীমাবদ্ধ রাখছি:
“একথা বলা হয় যে একাত্তরে আমরা একটি জাতি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করেছি। কথাটি ঠিক নয়, কারণ এ যুগে এক জাতি এক রাষ্ট্র এমন ব্যবস্থা সম্ভবই নয়। হ্যাঁ, বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষই বাঙালী, কিন্তু এখানেও ছোট আকারে হলেও অন্য জাতিসত্তা রয়েছে যারা বাঙালী নয়। আবার আমাদের জাতীয়তা বাঙালী না বাংলাদেশী এই বিতর্কও তৈরী করা হয়েছে। জাতির অনেকগুলো বাহ্যিক প্রকাশ রয়েছে, কিন্তু অন্তর্বস্তুতে জাতি হচ্ছে একটি চেতনা। এই চেতনা বিভিন্ন বস্তুগত উপাদানের ওপর নির্ভর করে। তবে প্রধান উপাদান ভাষা। অর্থনীতি, ভৌগোলিক অবস্থান, ইতিহাস, এরাও গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু জাতিগত পরিচয় নির্ধারণে প্রধান উপাদান হচ্ছে ভাষা। সেই হিসেবে এই উপমহাদেশে কখনোই এক জাতির দেশ ছিল না। ইউরোপের মতোই ভারতবর্ষও বহুজাতির দেশ, ১৯৪৭ সালে এখানে অন্তত সতেরটি জাতিকে চিহ্নিত করা সম্ভব ছিল, যাদের প্রত্যেকেরই ভাষা আলাদা।”
আমি উপরোক্ত প্যারাগ্রাফের প্রথম চার পংক্তির সাথে সম্পূর্ণ একমত। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের উদ্ভব একটা জাতি-রাষ্ট্রের উদ্ভব নয়, কেননা বাংলাদেশ একাধিক জাতির সংমিশ্রনে গড়ে ওঠা এক রাষ্ট্র ব্যবস্থা। যেমন প্রখ্যাত ঐতিহাসিক আহমদ কামাল তাঁর পিএইচডি গবেষণা-প্রসূত চমৎকার গ্রন্থে (State Against the Nation : The Decline of the Muslim League in Pre -independence Bangladesh , 1947-54) দেখিয়েছেন যে পাকিস্তান রাষ্টের বিরুদ্ধে পূর্ব বঙ্গের বাঙালিরা — যারা আরেকটা জাতি হিসেবে ঘুমিয়ে ছিল — জেগে উঠলো, এবং বিরোধিতা করলো i আমরা জানি এই বিরোধিতাই প্রতিরোধের জন্ম দিয়ে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জন্ম দিল।এক কোথায় সব রাষ্ট্রই জাতি-রাষ্ট্র বা নেশন-স্টেট নয়। ভালো কথা!
কিন্তু আমি সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর নিম্নোক্ত বাক্যগুলোর সাথে একেবারেই সহমত হতে পারছি না : “জাতির অনেকগুলো বাহ্যিক প্রকাশ রয়েছে, কিন্তু অন্তর্বস্তুতে জাতি হচ্ছে একটি চেতনা। এই চেতনা বিভিন্ন বস্তুগত উপাদানের ওপর নির্ভর করে। তবে প্রধান উপাদান ভাষা। অর্থনীতি, ভৌগোলিক অবস্থান, ইতিহাস, এরাও গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু জাতিগত পরিচয় নির্ধারণে প্রধান উপাদান হচ্ছে ভাষা।” উনি বলেছেন, “অন্তর্বস্তুতে জাতি হচ্ছে একটি চেতনা”। বিলক্ষণ! এখানে দ্বিমত প্রকাশের ধৃষ্টতা আমার নেই । কিন্তু উনি এই “চেতনা” টাকে হঠাৎ গৌণ করলেন কেন, আর এর পরে যা বললেন সেটা আমার বোধগম্ম্য হচ্ছে না ! বোধগম্ম্য হলেও প্রচন্ড যুক্তিহীন বলে মনে হচ্ছে i তিনি বলছেন: “এই চেতনা বিভিন্ন বস্তুগত উপাদানের ওপর নির্ভর করে। তবে প্রধান উপাদান ভাষা। অর্থনীতি, ভৌগোলিক অবস্থান, ইতিহাস, এরাও গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু জাতিগত পরিচয় নির্ধারণে প্রধান উপাদান হচ্ছে ভাষা।” প্রধান উপাদান ভাষা! তাহলে তো উত্তর আফ্রিকাতে আরবি ভাষী ছয়টা আর মধ্য প্রাচ্যে আরো নয়টা আরব রাষ্ট্র থাকতো না i কানাডা আর যুক্তরাষ্ট্র তো শুধু ভাষার দিক দিয়ে মূলত ইংরেজি ভাষী দেশ নয়, তাদের ধর্ম ও নৃতাত্ত্বিক দিক দিয়েও প্রচুর মিল রয়েছে i একই প্রশ্ন ব্রিটিশ আর আইরিশদের দুটো ভিন্ন রাষ্ট্রের নাগরিকত্বের ব্যাপারেও করা যেতে পারে ! বহুদিনের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন আইরিশদের জাতীয় ভাষা গেইলিক আইরিশদের জন্য এক অপরিচিত/অব্যবহৃত ভাষায় রূপান্তরিত করে , ওদের মূলত ইংরেজি ভাষী বানালেও, আইরিশরা ইংরেজিভাষী ব্রিটিশদের সাথে একসাথে থাকতে অস্বীকৃতি জানিয়ে স্বাধীনতার সংগ্রাম শুরু করলো, এবং ১৯২১ সালে স্বাধীন আয়ারল্যান্ডএর জন্ম দিল i গেড়ে বার্নার্ড ষ ইংরেজিতে লিখলেও নিজেকে ইংরেজ নয়, গর্বভরে আইরিশ হিসেবে পরিচয় দিতেন। পাঞ্জাবি ভাষী ভারতীয় আর পাকিস্তানী পাঞ্জাবিরা ১৯৪৭ সালের পর মূলত ভারতীয় আর পাকিস্তানী হিসেবে পরিচিত।
তাই ভাষা কোন ভাবেই জাতীয়তার মূল, বা একমাত্র উপাদান হতে পারে না। ভূগোল, ধর্ম, race বা নৃতাত্ত্বিক মূল, বা common historical experience বা একই ধরণের ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা একটা জাতির মূল উৎস হতে পারে না। হিন্দি/হিন্দুস্তানী/উর্দু ভাষী বিহারি, আবধি, লখনৌয়ি, হায়দ্রাবাদি, মধ্যভারতী, রাজপূত, হারিয়ানবী জনগোষ্ঠী নিজেদের মূলত বিহার, উত্তর প্রদেশ, হায়দ্রাবাদ,মধ্যপ্রদেশ,রাজস্থান, বা হরিয়ানা বাসি বলে পরিচয় দেয়। তাই সব বাংলাভাষী নিয়ে একটা কল্পিত বাঙালি জাতির অস্তিত্বে যাঁরা বিশ্বাস করেন, তাঁদের সাথে যাঁরা সব আরবি ভাষী এক জাতিভুক্ত মনে করেন, তাঁদের কোন পার্থক্য নেই। মোদ্দা কথা, ভাষা, ধৰ্ম, ভূগোল, ইতিহাস, নৃতত্ব সমষ্টিগত ভাবে বা একা-একা কোন জাতির জন্ম দিতে পারে না। যেকোন ভূখণ্ডের জনগোষ্ঠী নিজেদের যতদিন চেতনার তারনায় বা কোন আবেগ বা কোন স্বার্থের বা pragmatism এর কারণে এক জাতিভুক্ত মনে না করবে ততদিন তাদের এক বা একাধিক উপাদান থাকার কারণে একটা ভিন্ন জাতি মনে করার কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই।
ন্যাশনালিজম নিয়ে রবীন্দ্রনাথ খুব সুন্দর আলোচনা করেছেন। Walker Connor খুব পরিশিলিত ভাষায় জাতির সংজ্ঞা নির্ধারণ করেছেন। তাঁর মতানুযায়ী “একটা সামাজিক গোষ্ঠীর (সোশ্যাল গ্রুপ) লোকেরা যখন মনে করে যে সমষ্টিগত ভাবে তারা একটা সাধারণ বিশ্বাস (ইডিওলজি), সাধারণ আচার-অনুষ্ঠান, চাল-চলন বা রীতি-নীতি, এবং একটা সাধারণ হোমোজেনাইটির চেতনা বা ধারণা পোষণ করে, তখনি তারা একটা ভিন্ন জাতি সৃষ্টি করতে পারে i ” তিনি অবশ্য এ ব্যাপারে খুব জোর দিয়েছেন যে তাদের চেতনা, ধারণা, মনোভাব, একাগ্রতা, আর তারা সবাই যে এক জাতিভুক্ত এই অপ্রতিরোদ্ধ ইচ্ছাশক্তি জাতি গঠনের মূল শক্তি, অন্য কিছু নয়।
বাঙালি এবং বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ, ইতিহাস আর রাষ্ট্রবিজ্ঞানের যে কোন সংজ্ঞানুযায়ী দুটো সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস। এখানে বাংলাদেশের বাঙালি আর ভারতীয় বা অনন্য কোন দেশের বাঙালিদের এক যায়ভুক্ত মনে করার অপর নাম অর্বাচিন্তা বই অনন্য কিছু নয়! ভারতের বাঙালিরা নিজেদের প্রথমত আর শেষাব্ধি ভারতীয় মনে করেন। পাকিস্তানেও কয়েক মিলিয়ন বাঙালি আছেন। তাঁদের নিজেদের পাকিস্তানী ছাড়া অন্য কিছু মনে করার মতো কোন অবকাশ এবং যৌক্তিকতা নেই। তাই এব্যপারে আমি আর সময় নষ্ট করচি না। এক কথায় গায়ের জোরে পাকিস্তানিরা যেমন পূর্ব বাংলার লোকদের পাকিস্তানী বানাতে পারে নি, তেমনি আমরা গায়ের জোরে ভারতীয় এবং পাকিস্তানী বাঙালিদের বাংলাদেশের বাঙালিদের সাথে এক করে ফেলতে পারি না। কেননা দিনের শেষে জাতি গঠনের সবচাইতে বড় উপাদান হলো একটা নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর অধিকাংশ সদস্যের আবেগ, চেতনা, আর তাদের অপ্রতিরোদ্ধ ইচ্ছাশক্তি।এর কোন ব্যতিক্রম নেই!
তাজ হাশমী
(ইতিহাস, রাজনীতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, ও ইসলাম বিষয়ক গ্রন্থকার, প্রাবন্ধিক, ও সমালোচক)
tajhashmi@gmail.com
The post সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর বাঙালি/বাংলাদেশী জাতীয়তার মূলনির্ণয় : আমার দ্বিমত ও পর্যালোচনা appeared first on Bangladesh Study Forum.